(লিখেছেনঃ হাফসা খান)
পিতা ব্যাংক কর্মকর্তা আফজাল হোসেন মেয়েকে শখ করে দামি মোবাইল ফোন সেট কিনে দেন সে কখন কোথায় থাকছে তার খোঁজখবর নেয়ার জন্য। কিন্তু মোবাইল কাল হয়ে দাঁড়ায়। স্কুলে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, রাতে না ঘুমিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলতে থাকে মেয়ে। না দেখেই মোবাইল ফোনে একটা ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় তার। সম্পর্ক গড়ে ওঠার কয়েক মাস পর তাদের দু’জনের দেখা হয়। কিন্তু দেখা হওয়ার পর জানা যায় ছেলেটি মোবাইল ফোনে খুব ভাল কথা বলতে পারলেও লেখাপড়া কিছুই জানে না। সে পেশায় রাজমিস্ত্রি। এরপর প্রচণ্ড মানসিক আঘাত। আশাহত অনুভূতির প্রচণ্ড চাপ। এ থেকে মানসিক ভারসাম্যহীনতা। ঘটনাটি দশম শ্রেণীর ছাত্রী সাথীর। মা আফসানা বেগম তাকে নিয়ে এসেছেন ধানমন্ডির মনোজগত সেন্টারে। মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য। তার রঙ ফরসা। শরীর শীর্ণ। অসম্ভব রোগাটে, মাথা ন্যাড়া। মা জানালেন তার মেয়ে প্রায় এক বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে। কিন্তু এ বয়সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে- এটা কি বংশীয় অসুখ? নাকি অন্যকিছু। এত প্রশ্ন শুনে মুখে আঁচল চাপা দেন মা। প্রশ্ন এড়াতে মেয়েকে নিয়ে একপাশে সরে গেলেন। কাছে গিয়ে আবারও প্রশ্ন করতেই ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেন। বলেন, বংশীয় কোন অসুখ নয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা বলেন, আমার মেয়ে খুবই মেধাবী ছাত্রী ছিল। ফাইভে ও এইটে দু’টোতেই বৃত্তি পেয়েছে। কিন্তু এখন অসময়েই ওর জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। মা বলেন, প্রথম দিকে বিষয়টিকে আমরা এত গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু ও হঠাৎ খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দিল। বান্ধবীদের সঙ্গে আর মেশে না। টিভি দেখে না। পড়াশোনা করে না। ওর শরীর আস্তে আস্তে খারাপ হতে লাগল। উল্টাপাল্টা কথা বলে। আমরা কি হয়েছে জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মেয়ের মুখ দিয়ে একটি কথাও বলাতে পারিনি। অথচ ওর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। অবস্থা এমন হলো যে ও আর বাথরুমেও যায় না। ঘরেই বাথরুম করে নোংরা করে রাখে। পরে ওর এক বান্ধবীর কাছ থেকে আমরা জানতে পারলাম কিন্তু এসব বিষয় আমাদের কাছে কিছুই বলেনি। ধীরে ধীরে ও নিজেই নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে শেষ হয়ে যেতে থাকে। ও যখন পুরোপুরি অসুস্থ তখন আমরা ওর এক বান্ধবীর মুখে ঘটনা শুনতে পাই।
বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মোবাইল ফোনে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠছে। সম্পর্ক গভীর হওয়ার পর তারা যখন একের অপরকে দেখেছে তখন তাদের সাজানো মানুষটির সঙ্গে বাস্তবের মিল থাকছে না। তখন ঘটছে বিপর্যয়। অনেকেই বিষয়টি কাটিয়ে উঠতে পারলেও অনেকেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। বিমর্ষতায় ভুগছে নয়তো মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু যে মোবাইল ফোনে প্রেমের কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে তা নয়। মোবাইল ফোনে প্রেমের অভিনয়ের জন্য পেশাদার একটি চক্রও গড়ে উঠেছে। গত মাসে র্যাব-৩ আসমা নামের এক মেয়েকে গ্রেপ্তার করে গুলিস্তান এলাকা থেকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে বিভিন্ন ছেলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতো। এরপর প্রেমিককে ডেকে নিয়ে অপহরণ করে তার বাবা-মায়ের কাছে মুক্তিপণ আদায় করতো। এ সময় পেশাদার মোবাইল প্রেমিকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন মোবাইল নম্বরে মিসড কল দেয়। কোন ছেলে কণ্ঠ ফোন ব্যাক করলে মিষ্টি কণ্ঠে কথা বলে। কথার জালে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। প্রথম দিকে তারা প্রায়ই ছেলেটিকে মোবাইলে টাকা পাঠাতে বলে। এরপর সব ঠিকঠাক করে ছেলেটিকে তাদের আস্তানায় আসতে বলে। এরপর তাকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এছাড়া ইন্টারনেট বেশ কিছু বাংলা ওয়েবসাইট রয়েছে যেখানে নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে মোবাইল ফোনে স্মার্ট নারী কণ্ঠের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কথা বলা যায়। চাইলে নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে তার সঙ্গে ডেটিংও করা যায়। এ ধরনের শতাধিক ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়ার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিটিআরসিতে পাঠানো হয়েছে। মনোজগত সেন্টারের চিকিৎসক বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ বলেন, মোবাইল ফোনে প্রেম-পরবর্তী অবসাদ সংক্রান্ত কেস প্রায়ই আসছে। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেটিকে না দেখেই অল্পবয়সী মেয়েরা মোবাইল ফোনে সুন্দর কণ্ঠস্বর শুনে পুরুষটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলছে। কিন্তু পরে যখন তারা একে অপরকে দেখেছে তখন তাদের কল্পনার সঙ্গে মিলছে না। এসব ক্ষেত্রের মেয়েরাই বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে। কল্পনার মানুষটির সঙ্গে না মেলায় এক ধরনের আশাহত অনুভূতির চাপে ভুগছে মেয়েটি। এখান থেকেই তার মানসিক রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মেয়েটি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। অনেক মেয়ে পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মোবাইল ফোনে প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে ছেলেটি মেয়েটির নানা ধরনের ছবি তুলে রাখছে। পরে মেয়েটিকে ওইসব ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে। যার পরিণতিতে মেয়েটি আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। ফিরোজ বলেন, এ ধরনের অবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো সন্তানের ওপর পরিবারের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়ানো। সন্তান কোথায় যাচ্ছে কি করছে সে বিষয়ে খোঁজখবর রাখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, প্রযুক্তির যেমন সুবিধা আছে তেমনি অসুবিধাও আছে। সমাজে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন না ঘটে এ জন্য মোবাইল ফোন বিক্রির ক্ষেত্রে একটা আইন করা জরুরি। যে আইনে বলা হবে কত বছর বয়স পর্যন্ত মোবাইল ফোন কেনা যাবে না। তিনি বলেন, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বাবা-মা সন্তানদের কাছে ওপেন বা ফ্রি নন। বাবা মা যদি ফ্রি হন তবে সন্তান কোথায় কি করছে তা তারা জানতে পারতেন। সন্তান বাবা-মাকে লুকিয়ে কোন কিছু করতো না। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা থেকেই সন্তানকে রক্ষা করা যেতো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন