আর কিছুক্ষণ পরই আমি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি। নিজ ইচ্ছায়। আমি জানি, আত্নহত্যা কাপুরুষের কাজ। ভেবেছিলাম কখনোই এরকম কাজ আমাকে করতে হবে না। কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে এই সিদ্ধান্ত নিতে। আমি অসহায়, আমি অযোগ্য এ পৃথিবীর। তাই আমার বিদায় নেয়াই ভালো।
আর সবার মত আমারো তো ইচ্ছে ছিল জীবনে বড় কিছু করবার! মা-বাবা’র মুখ উজ্জ্বল করবার। অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখতাম আমি। আকাশ টা ছুয়ে দেখার স্বপ্ন। কিন্তু আমাকে ঘিরে যে অগনিত মানুষের স্বপ্নসুর, তাদের জন্য কি করেছি আমি? তারা আমার জন্য বুনে গেছে সুরক্ষিত আবাস... আর আমি!
প্রথম যেদিন আমার ছোটভাইটা সিগারেট ধরল, কিছু বলিনি তাকে। কিন্তু কে জানত, সেই ছেলেটিকেই মাদকের নীল আগ্রাসন গ্রাস করে নেবে? হারিয়ে যাবে সে আমাদের মাঝ থেকে? এরকম লাখো মাদকাসক্ত যুবক আছে, একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য আমি কি করেছি?
ভুল চিকিৎসায় মারা গেছে আমার একমাত্র আদরের ছোটবোন। এরকম সহস্র বোন হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন ভুল চিকিৎসায়, অনাদরে, অবহেলায়, কিংবা যৌতুক প্রথার বলি হয়ে। তাদের জন্যে আমি কী করেছি?
বীর মুক্তিযোদ্ধা করিম আলী। পেটের দায়ে রিকশা চালান! দেশের বীর সন্তানের এই দুর্দশায় আমি কি করেছি? আমি কিছুই করতে পারিনি তার জন্য! তার মত অগনিত মুক্তিযোদ্ধা দুঃখ কষ্টে জর্জরিত হয় দিনানিপাত করছেন। তাদের জন্য কি দু ফোটা চোখের জলও ফেলেছি আমি?
এইতো সেদিন, পেটের দায়ে খাবার চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ল দুটি শিশু। তাদের উপর নেমে এল শাস্তির খড়গ! প্রহারে জর্জরিত হল তারা। সেদিনের সেই ভীড়ে আমিও তো ছিলাম! কই, গর্জে ওঠেনি তো আমার কন্ঠ! বলতে পারিনি, এদের কি দোষ? এদের কেন মারছেন? মারতে পারলে মারুন সে সব রাঘব বোয়াল কে, যারা আমাদের আর এদের মাঝে এত ব্যবধান গড়ে তুলেছে। পারলে ভাঙ্গুন সে সমাজ কে, অনৈতিক জেনেও যারা একে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু কই, আমার গলা দিয়ে একটু শব্দও তো বেরোল না!
এরকম হাজার হাজার ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে চারপাশে! আমি কিছু করতে পারছি না। আমার অবস্থাটা আসলে ফার্মের মুরগীর মতন! চাইলেই কিছু করতে পারিনা আমি! চাইলেই কোন কিছু বদলাতে পারি না! জবাবদিহি করতে হয়! সেই সমাজের কাছে, যারা নিজেরাই আত্নস্বীকৃত প্রতারক! কিন্তু এরকম কেন হল? এ তো আমারই ব্যর্থতা। আমরাই তৈরী করেছি এই তথাকথিত সভ্যতা, এর কাছে আজ আমরাই কোণঠাসা!
আমি সব নিয়ম ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছিলাম। প্রথার বেড়াজালে আর নয়! কিন্তু সাথে কাউকে পেলাম না! হয়ত আর সাবাইও আমার মত ভয় পায়! সবারই তো সংসার আছে। প্রিয়জন আছে, তাদের ভবিষ্যত আছে। সবকিছুকে দূরে ঠেলে কেন আসবে তারা এপথে, যেখানে প্রতিনিয়ত মৃত্যু লেখা থাকে! অতঃপর... যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে!
আমার বেছে নেয়া পথটা বোধহয় ঠিক ছিলনা! না হয় ঠিক ছিলনা আমার সময়। আমি যা করেছিলাম, দেশের প্রচলিত আইনে তাকে বলে হত্যাচেষ্টা! গর্হিত অপরাধ! কিন্তু আমার কাছে তা ছিল দিন বদলের সূচনা। আমি বজ্র হয়ে বিদ্ধ করতে চেয়েছিলাম সকল মুখোশধারী শয়তানদের, যাদের আকা বহ্নিশিখার নিচে পুতুলের মত নাচি আমরা সবাই! কিন্তু আমি পারিনি... বিবেকের দংশনে আমি বিক্ষত হয়েছি! আমি তো তাদের মত অমানুষ নই!
আমি পারিনি কারো কোন স্বপ্ন পুরণ করতে... পারিনি সবকিছু ভুলে নিজের জীবন নিয়ে মেতে উঠতে। আমার কোন কিছুর কমতি ছিলনা! কিন্তু এই সব অপূর্ণতা! এটা তো আমারই দেশ! অপুর্ণতাগুলো আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে! আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে আমি কাপুরুষ, আমার কোন ক্ষমতা নেই। আমি কিছুই করতে পারিনা। নাচের পুতুল আমি, যে যেভাবে নাচায় সেভাবেই নাচি... কিন্তু এসব সহ্য করে তো আমি থাকতে পারি না! আমি পারিনা আমার দেশের উপর হায়েনার হিংস্র থাবা পড়তে দিতে। তাই যদি আমি কিছু নাই করতে পারি, তবে আমার চলে যাওয়াই ভালো। অন্তত নিজের চোখে এসব দেখতে তো হবেনা!
যাবার আগে ঘাসের ভেতর খালি পায়ে হাটতে ইচ্ছে করছে। আর ইচ্ছে করছে শিশিরকণা ছুয়ে দেখতে......
মনে হয় আমি উল্টোপাল্টা বলছি। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যে যে মারা যাবে, তার এখন অপ্রকৃতিস্থের মতই আচরণ করার কথা। কিন্তু যে কথা গুলো আমি লিখে যাচ্ছি, তাতে কোন ভুল নেই, কোন মিথ্যা নেই। কাপুরুষের মত নিজের এইসব অক্ষমতা কে সঙ্গী করে চলে যাওয়া যেন অন্য কারো ভাগ্যে না ঘটে, সে জন্যই আমি লিখছি। আমি লিখছি আমাদের মধ্যে অগনিত আলোময় সেই মানুষ গুলোর জন্য, যারা আমার অক্ষমতা কে তাদের শক্তিতে রুপান্তর করতে পারে... যারা পারে এ দেশটাকে পালটে দিতে...
ইতি
(চিঠি তে কোন নাম পাওয়া যায়নি।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন