১ম পর্বের পর-
ট্রেনের কামরায় নিকষ কাল অন্ধকার। হটাৎ করে কামরায় ঢুকে চোখে আঁধার দেখল মুহিন। একটু পরে যখন আঁধার চোখ সয়ে গেল দেখতে পেল যে কে যেন একটা মোম জ্বেলে রেখেছে। বাতাসে মোমের শিখা তিরতির করে কাঁপছে। সে মোমের আবছা আলোয় দেখল এই বগিতে যাত্রী বেশি নেই। ১০/১৫ জন হবে। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে, কেউবা সিটে লম্বা হয়ে ঘুমাচ্ছে।
মুহিন একটা খালি সিট দেখে জানালার পাশে গিয়ে বসল। জানাল দিয়ে বৃষ্টি ভেজা বাতাস আসছে হু হু করে। সে একটা হাত বাড়িয়ে দিল জানালা দিয়ে। ভেজা বাতাস তার খোলা হাত ছুয়ে যাচ্ছে, হাতের খোলা অংশে ভেজা বাতাস লাগতেই তার শরীরে কাঁটা দিয়ে গেল। আবেশে চোখ বুজে এল তার।
জানালার মধ্যে হাত রেখে হাতের উপর মাথা রেখে বাইরের দিকে তাকাল।
বাইরে কি সুন্দর দৃশ্য! দিগন্ত জোড়া ধানের ক্ষেত বাইরে। কাল মেঘের ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ উকিঝুকি মারছে। সে অন্ধকার মেশানো চাঁদের আলোয় ভেসে গেছে সে দিগন্ত জোড়া ধান খেত, খাল, ঘুমন্ত বাড়ি ঘর!
পুকুর আর খালের পানিতে বৃষ্টির পানিতে সে চাঁদের আলো পড়ে হিরে মানিকের মত জ্বলজ্বল করছে। কি অসাধারন এক দৃশ্য!
হটাৎ একটা শ্লেষ মেশানো গলায় মুহিনের চিন্তার সুত্র ছিঁড়ে গেল।
-ভাইজান, আপনে কই যাইবেন?
মুহিন ঘাড় ফিরিয়ে দেখে একজন মাঝ বয়সি মানুষ। মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল।
সে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল- এই ট্রেন কোথায় যাবে?
লোকটি মুহিনের প্রশ্ন পালটা শুনে একটু অবাক হল। বলল- আপনে জানেন না এই ট্রেন কই যাইব? তাইলে উঠছেন ক্যান?
মুহিন বলল- দেখেন, আমি আজ ঘুরতে বের হইচি। কোথায় যাব ঠিক জানি না। তাই ট্রেন কই যাবে জানার আগ্রহ নাই। যেখানে ট্রেন থামবে সেখানে নেমে যাব।
লোকটি তার কথায় একটু অবাক হল মনে হয়। সে মুহিনের সামনের খালি সিটে বসে পড়ল। তারপর বলল- ও আচ্চা। বুঝতে পারছি। ভাল কাজ করছেন। আসলেই আমরা কেউ জানি না আমরা কোথায় যাচ্ছি!
মুহিন এই লোকের মুখে এত বড় দার্শনিক কথা শুনে একটু অবাক হল। সে লোকটার দিকে একটু ভাল করে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল- আপনি কই যাবেন?
লোকটি এক গাল হেসে বলল- আমিও আপনের মত কই যাই ঠিক নাই, আমার জীবন এই ঘুরে ঘুরেই কাটে। স্থায়ি কোন বসতি নাই।
একটু চুপ করে আবার বলল-ভাইজান আমার নাম আজিজ। কেউ কয় আজিজ বয়াতি, কেউ কয় আজিজ পাগলা, আমার কেউ কয় মজনু আজিজ। আমার নাম মজনু আজিজ ক্যান- ভাইজান কি জানেন?
মুহিন বিরস গলায় বলল- না জানি না। জানার ইচ্ছে হচ্ছে না।
মজনু আজিজ একটু বিষণ্ণ হল বুঝা গেল। সে আবার বলল- ভাইজান সে এক মজার হিস্টরি। তয় আমার কাছে সেটা দুক্ষের হিস্টরি। একজনের কাছে যা মজার আরেকজনের কাছে তা দুক্ষের। ঠিক বলেছিনা ভাইজান?
উফ! লোকটা বকবক করে মাথা ধরিয়া দিল। মুহিন আবার বলল- আপনি ঠিক বলেছেন। শুনেন ভাই- আমি একটু একা থাকব বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। আপনে এখন যান।
আজিজ বিরস গলায় বলল- শুনলে মজা পাইতেন। আপনে যখন শুনতে চান না তাইলে থাক। ভাইজানের কাছে কি বিড়ি আছে? থাকলে একটা দেন। কেমুন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগতাসে।
মুহিন একটা সিগারেট দিল লোকটিকে। লোকটি সিগারেট হাতে নিয়ে মোমের কাছে গিয়ে সিগারেট টা নেড়ে চেড়ে বুঝার চেষ্টা করল কোন ব্রান্ডের সিগারেট। তারপর আবার সিটে এসে বসল। তারপর সিগারেট পকেটে ঢুকিয়ে নিজের একটা বিড়ি বের করে ধরাল।
মুহিন অবাক হয়ে লোকটির কাজ দেখছে। লোকটি বলল- ভাইজান, আপনে আমারে এত দামি বিড়ি দিচেন আপনেরে আল্লা ভাল করব।
মুহিন হেসে বলল- ঠিক আছে। তবে আপনি সিগারেট না খেয়ে বিড়ি ধরালেন কেন?
লোকটি হেসে বলল- ভাল জিনিস ভাল টাইমে খাইতে হয়। দামি জিনিস পরে খামু।
মুহিন বলল- আপনার বিড়ির কড়া ধোঁয়া আমার সহ্য হচ্ছে না। আপনি আরেকটা সিগারেট নেন, তবুও আপনের বিড়ি ফালান। বলেই মুহিন আরেকটা সিগারেট বের করে তাকে দিল।
লোকটি হাত বাড়িয়ে আরেকটা সিগারেট নিয়ে আবার পকেটে ঢুকাল তারপর সিট ছেড়ে উঠে অন্য সিটে চলে গেল।
লোকটির আচারন দেখে মুহিন অবাক হল আবার মজাও পেল একটু।
সে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। একটা দিগন্ত বিস্তৃত জলাধার। চাঁদের আলো পড়ে কেমন চকচক করছে!
হটাৎ ট্রেনের গতি কমে এল। সামনে একটা ছোট গ্রামের স্টেশান। স্টেশানে ট্রেন থামল। এত রাতে গ্রামের স্টেশানে ট্রেন থামল কেন বুঝল লোকাল ট্রেনের কোন ঠিক ঠিকানা নাই। এই ট্রেনগুলো বিনা কারনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যেকোনো স্টেশানে থেমে থাকতে পারে!
মুহিন ট্রেন থেকে নামল। আরও কয়েকজনও নেমে এল ট্রেন থেকে। গ্রামের একটা সাধারন স্টেশান। স্টেশান মাস্টারের ঘরের সামনে একটা একশ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। আর পুরো স্টেশান অন্ধকার। মুহিন খেয়াল করে দেখল এই নির্জন স্টেশানে একটা আন্তঃনগর ট্রেন থেমে আছে। ঐ ট্রেনের যাত্রীরা এদিক সেদিক ঘুরা ফেরা করছে।
এত রাতে এই ছোট স্টেশানে কেন একটা আন্তঃনগর ট্রেন থামল? একটু পরে জানা গেল যে সামনে কোথায় যেন রেললাইন ভেঙ্গে গেছে। সেটা সারতে অনেক সময় লাগবে। কতক্ষণ যে লাগবে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারল না।
ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন রেল কম্পনির বাপ মা তুলে গালি দিল।
মজনু আজিজ আবার মুহিনের পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর কোন প্রসংগ ছাড়াই বলল- ভাইজান, মানুষের মনে দুইটা দুনিয়া। এক দুনিয়ায় সব আছে, সুক, আনন্দ, আপন জন। আরেক দুনিয়ায় আচে সুধু দুক্ক, বেদনা, সৃতি। এই দুনিয়ায় মানুষটা একলা। আমি একলা দুনিয়ার ইস্থায়ি বাসিন্দা। আর আইজ আপনে হেই একলা দুনিয়ার টেম্পুরারি বাসিন্দা। ঠিক বলেছিনা ভাইজান?
মুহিন মুগ্ধ চোখে মানুষটার দিকে তাকাল। এত সুন্দর দার্শনিক কথা বার্তা লোকটা জানে কিভাবে?
আকাশের চাঁদ আবার হারিয়ে গেল মেঘের আড়ালে। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হল।
হটাৎ মুহিনের ঘোর লেগে গেল। সেই টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাটা শুরু করল একটা বনের দিকে।
মুহিনকে হটাৎ গভীর বনের দিকে যেতে দেখে তার পিছনে পিছনে হাটা ধরল মজনু আজিজ।
মুহিন একমনে হেঁটে যাচ্ছে। ছোট একটা জংগল। গাছের পাতা ভেদ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে না। নিকষ কাল অন্ধকার সেখানে। তবুও মুহিন ঘোর লাগা মানুষের মত হেঁটে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে সে জানে না।
জংগলে হাজার হাজার জোনাকি জ্বলছে। মনে হচ্ছে একটা কাল চাদরে হাজার হাজার হিরে জ্বলছে। কি অদ্ভুত এক দৃশ্য!
ছোট জঙ্গলটা পেরিয়ে মুহিন দেখে একটা ছোট নদী। মুহিন সে নির্জন নদীর পাড়ে বসে গেল। পিছনে একটু দূরে স্টেশানটা ছাড়া আশেপাশে কোন বসতি নাই, কোন মানুষ নেই। খুব নির্জন এক নদীর পাড়।
বৃষ্টি আবার থেমে গেল। আবার আকাশে চাঁদ হাসি দিয়ে উঠল।
মুহিনের মনে আজ অনেক বিষণ্ণতা ভর করেছে। আসলেই কি মুহিন খুব একা একটা মানুষ? কি নেই তার? অনেক ভাল চাকরি করে, বাবা মা তাকে অনেক ভালবাসে। তবুও কিশের অভাব মুহিনের যে কারনে মাঝে মাঝে মুহিনের নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে- এই যেমন আজ করেছে মুহিন।
মুহিনের ঠিক পিছনে মজনু আজিজ এসে দাঁড়াল। তারপর মুহিনকে বলল- ভাই, আপনের মেচ বাত্তিটা দেন তো, একটা দামি বিড়ি ধরাই। আমার মেচ ভিজি গেছে।
মুহিন পকেট থেকে লাইটারটা নিয়ে নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে লোকটিকে লাইটারটা এগিয়ে দিল। লোকটি সিগারেট ধরিয়ে মুহিনের পাশে এসে বসল।
তারপর বলল- ভাইজান, সবার দুঃখ আছে, গরিবের দুঃখ আছে, বড়লোকের দুঃখ আছে। সে দুক্ষের মাইদ্ধে পিরিতির দুঃখ বড় দুঃখ। এই দেখেন আমি এত গরিব, ঘর বাড়ি কিচ্ছু নাই তারপরেও পিরিতির দুঃখ আছে। অনেক দুঃখ ভাই।
মুহিন উদাস গলায় বলল- আপনের আবার পিরিতের কি দুঃখ?
লোকটি বলল- এক ওষুধ বেপারি স্টেশানে হাবিজাবি ওষুধ বেচত। আমি সেই মজমায় গান গাইতাম।
মুহিন বলল- তারপর?
লোকটি বলল- আমার লগে একটা মেয়েও গান গাইত। মেয়েটারে আমি অত্তধিক ভালবাসতাম। মেয়েও আমারে ভালবাসত। কি সুখের দিন ছিল গো ভাই। আহা!
মুহিন বলল- তারপর?
লোকটি একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল- তারপর আর কি? মেয়েটা দেখতে সন্দর আচিল। পরে হেই ওষুধ অলার কাছে মেয়েটা বিয়া বইচে আমারে থুইয়া। আমার কিচ্ছু নাই, আমারে মেয়ে বিয়া করব ক্যান? আমার ঘর নাই বাড়ি নাই। তারপরে আমি হেই লোকের কাম ছাইড়া দিয়া নিজেই স্টেশনে স্টেশনে গান গাই। আর বিয়া শাদি করি নাই আমি।
তারপর লোকটা খালি গলায় একটা গান ধরল-
“আশা নদীর বালুচরে বাঁধি আমি খেলা ঘর
দুচোখের দুই সরবরে-
যখন তখন ভাসেরে সেই ঘর আমার
ভাসেরে সেই ঘর। “
কি অদ্ভুত সুন্দর গলা লোকটার! গানের সুর যেন ছড়িয়ে পড়ছে এই ছোট নদীর দুই পাড়ে। মুহিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল লোকটির দিকে। চাঁদের আলোয় দেখতে পেল লোকটির দুই গাল চকচক করছে। নিঃশব্দে কাঁদছে লোকটি।
মুহিন আবার সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল। তারপরে সিগারেটের আগুনটার দিকে তাকিয়ে ফিরে গেল বেশ কিছুদিন পেছনে। তারও একটা মনের মানুষ ছিল। সময়ের স্রতে হারিয়ে গেছে সে। আজ সে বহু দূরে, অনেক দূরে। এত দূরে চলে গেছে সে মানুষটি যে সে চাইলেই নাগাল পাবে না তার। মুহিন একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে মানুষটির জন্য নিষ্ফল অপেক্ষায় একা একা কাটিয়ে দিয়েছে কত গুলো দিন। মুহিনের সব সময় মনে হত এই বুঝি সব ভুলের অবসান ঘটিয়ে সে ফিরে আসবে তার কাছে!
না। আর না। হটাৎ মুহিনের চেয়াল শক্ত হয়ে গেল। একটা মানুষের জন্য সে আর কত অর্থহীন অপেক্ষা করবে? যেখানে জানে যে মানুষটি তার জীবন থেকে চলে গেছে সে আর ফিরে আসবে না। সে মানুষটি মুহিনকে ভুলে অনেক সুখে আছে তবে মুহিন কেন বিরহের আগুনে প্রতিনিয়ত জ্বলছে? মুহিনের তো কোন দোষ ছিল না, তবে?
অনেক হয়েছে। আর না। মুহিন উঠে দাঁড়াল। হাত থেকে সিগারট নদীর জলে ছুঁড়ে মারল। মজনু আজিজের দিকে তাকাল মুহিন। এই পাগল কিচিমের মানুষটির সাথে মুহিন তার নিজের অনেক মিল খুঁজে পেল। মুহিনের মত এই লোকটিও তার ভালবাসার মানুষের জন্য অর্থহীন অপেক্ষা করে যাচ্ছে।
মুহিন বলল-শুন আজিজ, মানুষের জীবন একটা, ঠিক কিনা বল।
মজনু আজিজ মাথা দুলিয়ে বলল-হু ভাইজান।
মুহিন বলল- তুমি যে মেয়েটিকে ভালবাসছ সে মেয়েটি কি তোমাকে ভুলে সুখে ঘর সংসার করছে, করছে কিনা বল?
মজনু আজিজ বলল- হু।
“তাহলে তুমি কেন কষ্ট পাচ্ছ? তোমার ভালবাসার মানুষ যেখানেই থাকুক সুখে আছে- এটা কি তোমার জন্য বিশাল পাওনা নয়? আর সে মানুষটিকে যদি তুমি বিয়ে করতে তাহলে হয়ত এতটা সুখে রাখতে পারতে না। তাই না?
মজনু আজিজ কিচ্ছু বলল না, এক দৃষ্টিতে মুহিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হল মুহিনের কথার গুঢ় অর্থ বুঝার চেষ্টা করছে।
আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুহিনের দিকে চোখ ফেরাল আজিজ, বলল-ভাইজান, আমি তো কখনো এরাম করে ভাবি নাই।
‘এবার বুঝতে পারছ তো? শুন আমিও তোমার মত একটা মেয়েকে ভালবাসতাম। মেয়েটা আমাকে ফেলে চলে যায়। এখন সে হয়ত সুখেই আছে। আমি মিছে মিছি এত দিন তার অপেক্ষায় থেকে সুধু কষ্ট পেয়েছি। বলে মুহিন উঠে দাঁড়াল- হু চল, আমাদের জীবন আরও অনেক বাকি। দেখা যাক ভালবাসার জন্য আর কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় কিনা!
বলে মুহিন স্টেশানের দিকে হাঁটা ধরল। পিছন ফিরে দেখল আজিজ বসে আছে। সে মনে হয় আসবে না। হয়ত সেই মেয়েটির জন্য সে আরও অপেক্ষা করবে। মুহিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
মুহিন স্টেশানে এসে দেখে ট্রেনের লোকজন এদিক সেদিক ছড়িয়ে আছে। হটাৎ ৫/৬ জনের একটা জটলার ভেতর শুনতে পেল একটা মেয়ে রাগি গলায় চিল্লাচিল্লি করছে- বলেছি তো আমাদের কোন সাহায্য লাগবে না। সুধু সুধু কেন বিরক্ত করছেন?
আরে এই গলাতো মুহিন চিনে! মুহিন লোকাল ট্রেনের পাশে দাঁড়ান আন্তঃনগর ট্রেন এবং মেয়েটির গলা শুনে যা বুঝার বুঝে নিল। নির্জন স্টেশানে কোন মেয়েকে একা পেয়ে বখাটেরা উৎপাত করছে।
মুহিন জটলার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর উঁচুগলায় বলল- “কিরে নিতু, কি হইচে? এরা কি বলতেসে?
বুদ্ধিমতি নিতু যা বুঝার বুঝে নীল। বলল-দেখ না ভাইয়া, তুমি আমাদের রেখে দোকানে গেছ, আর এই লোকগুলা আমাদের সেই থেকে বিরক্ত করছে।
মুহিন আগুন গরম চোখে লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল-কি চাই? এরা আমার বোন।
লোকগুলো একটু ইতস্তত করতে লাগলো। এমন সময় সেখানে হাজির মজনু আজিজ। “এই কি হইচে, কি হইচে?
তারপর বখাটে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল-ঐ তোগ এহানে কি? ভাগ কইলাম। এনারে চিনস? ইনি আমার ভাই। বেশি ফাইজলামি করলে একদম ট্রেনের চাক্কার নিচে কল্লা হান্দায়া দিমু।
লোকগুলো হয়ত আজিজকে আগ থেকেই চিনত। আজিজের পরিচিত লোক দেখে আর ঝামেলা না করে একদিকে চলে গেল।
আজিজ মুহিনের দিকে ফিরে হেসে বলল-ভাইজান, আমি আপনার কথা বুঝতে পারি নাই তখন। এখন আমার মাথায় ঢুকছে। আমি আর পাগলামি করুম না। এই শিতেই শাদি করুম ইনশাল্লাহ!
মুহিন একটু হেসে নিতুদের দিকে ফিরল। বর্ষা মেয়েটা নিতুর হাত শক্ত করে ধরে আছে। ভয় পেয়েছে মেয়েটা অসম্ভব বুঝা গেল। বর্ষার মাথাটা থেকে থেকে দুলছে। মনে হচ্ছে এখনি ঘুরে পড়ে যাবে। সাহসি মেয়ে নিতু ভয় পেলেও হাবভাবে বুঝা যাচ্ছে না।
নিতু বলল- মাই গড! ভাইয়া ভাবতেও পারিনাই এই স্টেশানে এই বিপদে আপনার সাথে আবার দেখা হয়ে যাবে! জীবনে ফেরেস্তা দেখলেও এত খুশি হতাম না আজ আপনাকে দেখে যতটা খুশি হয়েছি আমি!
তারপর কিভাবে মুহিন এ স্টেশানে আসল সব খুলে বলল মুহিন। আজিজের সাথে কিভাবে পরিচয়।
সব শুনে নিতু বলল- ভাইয়া কেন এত পাগলামি করেন বলেন তো? আমাদের জীবন কি এতই ছোট যে একটা মানুষের জন্য সব থেমে যাবে?
মুহিন বলল-হু, পাগলামি ছেড়ে দিব ভাবছি। অনেক তো হল আর কত!
এমন সময় আজিজ খবর নিয়ে এল আজ সারারাতেও লাইন ঠিক হবে না। এখান থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে একটা বাস স্ট্যান্ড আছে ওখানে যেতে হবে হেঁটে। এত রাতে এখানে কোন রিক্সা পাওয়া যাবে না।
সবাই ঠিক করল যে সারারাত বসে না থেকে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে চেষ্টা করাই ভাল।
গ্রামের কাঁচা রাস্তা। তিন ব্যাটারির টর্চ আর নিতু বর্ষার ব্যাগ কাধে নিয়ে আগে আগে হাঁটছে আজিজ, পেছনে মুহিন তার এক পাশে নিতু আর অন্য পাশে বর্ষা। নিতু মেয়েটা মুহিনের হাত ধরে আছে আর বর্ষা একটু দূরে দূরে হাঁটছে। এই রাতের বিপদ কিছু অপরিচিত মানুষকে বেঁধে দিয়েছে জন্মান্তরের বাঁধনে। এ বাঁধন, এ বিশ্বাস সহজে ছিঁড়ে যাবার মত নয়। মুহিন ঠিক করেছে আজিজ লোকটাকে তার বাড়িতে একটা কাজ দিয়ে দিবে। ছুটিতে দেশে আসলে প্রতি সন্ধায় আজিজের মধুর গলার গান শুনবে সে। এবার আর নিশ্চয়ই বিরহের গান গাইবে না আজিজ!
নিতু মেয়েটা কি মনে করে মুহিনের হাত ছেড়ে সামনে আজিজের পাশে চলে গেল। আজিজের সাথে কি সব গল্প শুরু করে দিল। বেচারা আজিজ! নিতুর পাল্লায় যখন পড়েছে তখন বুঝবে তার চেয়েও বড় পাগল এই দুনিয়ায় আছে!
দূরে কোথাও শেয়াল ডেকে গেল। ভয়ে বর্ষা হটাৎ মুহিনের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো।
মুহিন বলল- কি ভয় লাগছে? ভয়ের কিচ্ছু নেই বোকা মেয়ে। আমি আছি না!
বর্ষা বলল-তবুও আমার ভয় লাগছে। আমি আপনার হাতটা ধরি?
মুহিন উদাস গলায় বলল- অনেক বছর আগে একজন মানুষ অনেক ভালবাসা নিয়ে আমার হাত ধরেছিল। আজ সে অনেক দূরে।
বর্ষা অভিমানি গলায় বলল-যে চলে গেছে থাক না তার কথা। আমরা দুজন মিলে দোয়া করি উনি যেন সুখে থাকেন।
একথা বলে দুজনই চুপ। যেন এক মহাকালের নিস্তব্ধতা ভর করেছে দুজনের মাঝে।
কি যেন ভেবে বর্ষা বলে উঠল- আমি জানি আমি খুব বোকা একটা মেয়ে। আমি কখনো একা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। নিতুই আমাকে সবসময় সব বিষয়ে সাহায্য করে। আজ আমি একা একটা সিদ্ধান্ত নিতে চাই। আমি আপনার হাতটা ধরতে চাই সারা জীবনের জন্য। আমার মত বোকা একটা মেয়ে আপনাকে সুখি করতে পারবে কিনা জানি না তবে এতটুকু কথা দিতে পারি আমি এত হাত কখনো ছাড়ব না।
মুহিন কিছু বলল না। বর্ষার মায়াবি মুখের দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। তার মনে হল-এই মায়া ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে ভুলে থাকা যায় অসীম দুঃখমালা, কাজল কাল চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাওয়া যায় গভীর রাতের মাঝ সমুদ্রের কাল নোনা জল।
মুহিন কিছু না বলে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। বর্ষা সেটা দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে একমনে হাটতে লাগলো।
পরিশেষ-
বর্ষার ভয়ের কারনে মাথার দুলুনি একেবারে কমে গেছে। তার পাশে এখন মুহিন আছে, আছে মুহিনের ভালোবাসা। সেজন্য ভবিষ্যতে বর্ষার এ রোগ সেরে যাবে বলে আশা করা যেতে পারে।
নিতু মজনু আজিজকে খালি খেপাচ্ছে। আজিজ এই পাগলি মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। আজিজ মনে মনে বলল-হে খোদা! এই পাগলা মেয়ের হাত থিকা আমারে উদ্ধার কর!
নিতু একবার পিছনে ফিরে দেখল মুহিনের হাত ধরে তার প্রান প্রিয় বান্ধবি হেঁটে আসছে। অনেক ভাল লাগায় বুক ভরে গেল নিতুর। যাক, বোকা মেয়েটা তাহলে নিজে নিজে একটা ভাল সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে!
নিতু খুশি মনে আবার পথ চলতে লাগলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন