expr:class='"loading" + data:blog.mobileClass'>
চলছে । চলবে । অবিরাম...

সমুদ্রের ডাক


দেশে ফিরেছি মাত্র দুই মাস। এর মাঝেই বোরিং লাগতে শুরু করেছে। এখন যেন সময় কাটছ না। আমি জাপান থেকে এসেছি। জাহাজে চাকুরী করি। চাকুরীর কন্ট্রাক শেষ। জাহাজ জাপান ছিল। তাই বিমানে করে দেশে ফিরেছি। প্রায় সাত মাস পর দেশে ফিরেছি।

আমাদের শহরে বাড়ি নেই। আমাদের বাড়ি গ্রামে। অবস্সো গ্রামই আমার ভালো লাগে। দেশে আসার পর প্রথম কিছু দিন আত্তীয় স্বজনদের সাথে দেখা করে কেটে গেছে। তারপর একদিন চট্রগ্রাম গিয়ে আমার শিপিং অফিসে আমার সিভি, সিডিসি, পাসপোর্ট ইত্যাদি জমা দিয়ে এসেছি। জাহাজে পোস্ট খালি হলে আমাকে ফোন করে জানাবে। জাহাজের চাকরির এই এক মজা প্রতিবার নতুন জাহাজ, নতুন নতুন দেশ!
আমি একজন সাধারণ মানুষ। স্কুল জীবনে একটা মেয়ের সাথে প্রেম ছিল। এক সময় মেয়েটি আমাকে ছেড়ে চলে যায়- তারপর ওই পথ আর মাড়ায়নি। এখন মেয়ে মানুষ দেখলে ভয় লাগে! মেয়েদের আমার কারেন্ট জলের মত মনে হয়- কাছে জানা যদি জড়িয়ে পড়ি!

সেদিন রবিবার। সকালে পাশের গ্রামের হাবিব ফোন করে ওদের কলেজে যেতে বলল। হাবিব আমার জুনিয়র ফ্রেন্ড। গ্রামের কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে। হাবিব খুব ভালো ছেলে।
আমি নাস্তা খেয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম। একটা রিক্সা নিয়ে সোজা চলে গেলাম রেললাইনের ধারে। ওখানে একটা ছোট পুল আছে। পুলের নিচে ছোট খাল, দুপাশে ধানের ক্ষেত। পুল থেকে ঠিক এক কিলোমিটার পরেই মেহার ডিগ্রী কলেজ। হাবিব সেখানেই পড়ে।

এই পুলটা আমার খুব প্রিয়। আমি যখন ছ্যাকা খেয়েছিলাম তখন সন্ধার পর এই পুলের কাছে আসতাম। একা একা অনেকক্ষণ বসে থাকতাম। চার পাচটা সিগ্রেট খেতাম। রাত গভীর হলে বাসায় ফিরতাম। অনেকদিন এখানে আসা হয়নি।
রেল লাইনের উপর বসে একটা সিগারেট খেয়ে হাবিবের কলেজে গেলাম। দেখি হাবিব আমার জন্য অপেক্ষা করছে। অনেক দিন পর দেখা। কুশলাদি বিনিময়ের পর মাঠের মাঝ দিয়ে দুজন মূল ক্যাম্পাসের দিকে চললাম। কলেজের মাঠটা সুন্দর। ছেলে-মেয়েরা মাঠের মাঝে বসে গল্প করছে। গ্রামের ছেলে-মেয়েরাও অনেক আধুনিক হয়ে গেছে। খোলা মাঠের মাঝেই বসে দল বেধে গল্প করছে।
আমি কিছুটা আন-ইজি ফিল করতে লাগলাম। কলেজের সবাই আমার অপরিচিত। সবাই আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে, বিশেষ করে মেয়েরা।
হাবিবকে ব্যাপারটা জানাতেই বলল- কয়েকজনের সাথে আলাপ করিয়ে দেই, গল্প করেন। ভালো লাগবে।

আমারা দুজন দোতলায় গেলাম। সেখানে চার/পাচ জনের একটা গ্রুপ গল্প করছে। হাবিব আমাকে সেখানে নিয়ে গেল।
হাবিব ওদের জিজ্ঞাস করলো- তোমরা কেমন আছ?
ওরা সমস্সরে জবাব দিল- ভালো আছি ভাইয়া, আপনি কেমন আছেন?
হাবিব জানাল ও ভালো আছে। তারপর আমাকে দেখিয়ে বলল- ইনি হচ্ছেন শাওন ভাই, আমার খুব ক্লোজ সিনিয়র ফ্রেন্ড। শাওন ভাই জাহাজে চাকুরী করেন, মেরিন অফিসার।
ওরা কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো। যে মেয়েটা সবচাইতে মিষ্টি দেখতে ও বলল- ভাইয়া চাকুরি করেন! আপনার বয়সতো একদম কম!
আমি হেসে জানালাম- জাহাজের চাকুরী খুব অল্প বয়সেই ঢুকতে হয় আর সারাজীবন ধরে ডাক্তারদের মত পড়াশুনা করতে হয়!
তারপর সবার সাথে পরিচিত হলাম। ওরা এ কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। মিষ্টি মেয়েটার নাম বর্ষা।

আমি খুব মিশুক মানুষ তাই গ্রামের সহজ সরল কিশোর কিশোরীদের সাথে ভাব জমাতে দেরী হলো না। আমরা অনেকক্ষণ গল্প করলাম।
জাহাজ নিয়ে ওদের অনেক আগ্রহ। জাহাজে আমি কি করি, কোথায় ঘুমায়, কে রান্না করে, কোন কোন দেশে যাই, ঝড়ের সময় ভয় লাগে কিনা ইত্যাদি!
আমার ল্যাপটপে জাহাজের অনেক ভিডিও আছে তাই ওদের আমার বাসায় যাওয়া আমন্ত্রণ করলাম। সব শেষে বিদায় নিলাম। তবে আসার সময় ওয়াদা করে আসতে হলো যে প্রতিদিন ওদের সাথে এসে আড্ডা দিতে হবে।

বাসায় এসে বুঝতে পারলাম বর্ষা নামের মেয়েটার কথা আমি ভাবছি! আর মেয়েটার চোখেও অন্যরকম ভালোলাগা দেখেছি! তাই ঠিক করলাম কাল থেকে আর কলেজে যাব না। পরদিন সকালে হাবিব ফোন করে জানতে চাইলো- আমি কলেজে যাব কিনা?
আমি বলাম- আমি যাব না।
এভাবে তিন চার দিন কেটে গেল অলস সময় আর কাটে না। সারাদিন ঘুমাই, টিভি দেখি, সন্ধ্যার পর ওই পুলের কাছে যাই। কবে যে অফিস থেকে ফোন আসবে কে জানে!
একদিন সকালে নাস্তা খেয়ে গান শুনছিলাম এমন সময় হাটাত ডোর বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখি বর্ষাদের ওই গ্রুপ সাথে হাবিব!

আমাকে দেখে বর্ষা বাচ্চা মেয়েদের মত চিত্কার দিয়ে বলল- ভাইয়া আপনার অনেক ভাব হইচে, না? কলেজে যাবেন বলে গেলেন না। আমরা আপনাকে অনেক মিস করছি!
হাবিব হেসে বলল- ভাইয়া আমরা আপনাকে মিস করি নাই। বর্ষা মিস করছে সুধু!
শুনে বর্ষা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। আমি না বোঝার ভান করে বললাম- খুব ভালো!
বাসায় একা ছিলাম। আম্মু স্কুলে গেছেন। ফ্রিজ থেকে খাবার এনে ওদের খাওয়ালাম। বর্ষা আমার বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখল। তারপর জাহাজের ভিডিও গুলো দেখে চলে গেল।

ওরা চলে যাবার পর রুমে এসে বর্ষার কথা ভাবতে লাগলাম। সহজ মেয়েটা আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তার আচার আচরণে সবাই ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে।
গ্রামের মেয়েদের প্রেম অনেক ভয়ানক হয় শুনেছি। একবার কারো প্রেমে পড়লে তার জন্য সব করতে প্রস্তুত! মেয়েটিকে আমার ভালো লেগেছে। গ্রামের মেয়েদের বিয়ে হয় দ্রুত। আমার বিয়ের বয়স হতে হতে ও দুই বাচ্চার মা হয়ে যাবে! তাই মেয়েটিকে সুধু সুধু মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে লাভা কি? স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্ট আমি বুঝি।
হটাত খেয়াল করে দেখি আমার ল্যাপটপের নিচে একটা চিঠি!
খুব সুন্দর করে লেখা-

শাওন ভাইয়া,
আমার চিঠিটা দেখে খুব অবাক হয়েছেন নিশ্চয়! মোবাইলের যুগে কেউ চিঠি লেখে? আমি লেখলাম কারণ আমার মোবাইল নাই। হাবিব ভাই থেকে আপনার সব কথা শুনেছি। আপনি যে একটা ছ্যাকা খেয়েছেন তাও জানি! প্লিজ রাগ করবেন না। বিশ্বাস করেন আপনাকে আমার কত ভালো লেগেছে তা বলে বোঝতে পারব না। আমি আপনাকে ......... না, কথাটা আমি আপনাকে সরাসরি বলতে চাই। আপনি কাল সকাল দশটায় আপনার প্রিয় পুলটার কাছে আসবেন। আসবেন তো? আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনি আসবেন না। তবুও আমি অপেক্ষা করব।
ভালো কথা, আমি সত্যি বলছি আমি কখন আপনাকে কষ্ট দিব না।প্রমিজ।
ইতি-বর্ষা

চিঠিটা পড়ে মাথা ঘুরে গেল! কি করব বুঝতে পারছি না। বিকালে আমার শিপিং অফিস থেকে ফোন আসলো যেন আমি কাল বিকালে চিটাগং থাকি। পরশু সিঙ্গাপুর যেতে হবে। জাহাজ সিঙ্গাপুর আছে। এই হলো জাহাজের চাকরি!!
রাতে আম্মু ব্যাগ ঘুচিয়ে দিল। সকালে বাসের টিকেট কাটতে বের হলাম আর বর্ষাকেও না করে আসতে হবে। এই জীবনে আর প্রেম করা হবে না।

ঠিক দশটায় পুলের কাছে গেলাম। দেখি বর্ষা আগে থেকেই অপেক্ষা করছে। গোলাপী রঙের জামার সাথে গোলাপী ওড়না। ওকে ঠিক গোলাপী পরীর মত লাগছে! কলেজের বইগুলো শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আছে যেন এগুলো তার শেষ সম্পদ! তার মায়াভরা চোখে কিসের যেন ব্যাকুলতা!
আমি তার কাছে গিয়ে বললাম- বর্ষা, আমি আজ চিটাগং চলে যাচ্ছি, পরশু আমার সিঙ্গাপুর ফ্লাইট। আমি ছয় মাস পর দেশে ফিরব। বর্ষা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল। বুঝলাম বোকা মেয়েটা এবার কেদে ফেলবে!
বর্ষা অস্ফুট স্বরে বলল - আমি আপনাকে যেতে দেবনা!-বলেই কেদে ফেলল!

মেয়েটির এ ভালবাসা আমার পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব না, এত প্রবল ভালবাসা উপেক্ষা করার শক্তি আল্লাহ আমাকে দেননি।
আমি বললাম- আরে বোকা মেয়ে কাদ কেন? শুন মেয়ে, আমার চাকুরীটাই। এমন ৫/৬ মাস চাকুরী করব তিন মাস দেশে থাকব, এতে আপনার চলবে?
আমার কথা শুনে মেয়েটি হেসে দিল! হাতে উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছল।
আমি বললাম- আমার জন্য তোমাকে আরো তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে, পারবে না?
বর্ষা এবার হেসে দিল- আমি আপনার জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করব, প্রমিজ!
আমি হটাত টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হলো।
বললাম- চল যাই, আমাকে আবার চট্রগ্রামের বাস ধরতে হবে।
আমরা দুজন রেল লাইন ধরে ফিরছি। বৃষ্টির মাঝে দুজনই ভিজছি। বর্ষা আমার কাছ থেকে দুরে দুরে হাঁটছে, তবুও বুঝতে পারছি মেয়েটা কাঁদছে!

আমি বর্ষার একটা হাত সরে বললাম-আমি তোমার পাশে থাকব সবসময়।
বর্ষা আবার বাচ্চা মেয়ের মত ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলল- আমাকে কখনো ভুলোনা প্লিজ, আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।
আমি বর্ষার ভেজা হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বললাম- আমিও তোমাকে অনেক ভালবাসি।
পথ শেষ। এবার বিদায়ের পালা। আমি শেষ বারের মত বললাম- ভালো থেক বর্ষা। বর্ষা কোনো কথা বলতে পারল না- শধু কাঁদছে।
আমি আমার মনকে শক্ত করে নিলাম নয়তো বাস মিস হয়ে যাবে। ফিরতে ফিরতে খেয়াল করলাম আমিও কাঁদছি!

-----
ওই বিদায় ছিল আমার আর বর্ষার শেষ বিদায়। তার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। পাচ মাস পর দেশে ফিরে হাবিব থেকে শুনলাম- দুই মাস আগে বর্ষার বিয়ে হয়ে গেছে!
আমি আগের মত ওই পুলের কাছে যাই.. একটা সিগারেট জ্বালিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি আর একটা ফোনের অপেক্ষা করি কবে আবার সমুদ্রের ডাক আসবে......... কবে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন