expr:class='"loading" + data:blog.mobileClass'>
চলছে । চলবে । অবিরাম...

"মাঝ রাতের ট্রেন এবং নিঃসঙ্গ প্রেম-১ম পর্ব"


রাত ৮ টা।
লাকসাম রেলওয়ে জংশন।

মুহিন একটা ফ্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা বেনসন সিগারেট। একটু পর পর লম্বা টান দিচ্ছে সিগারেটে আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে বিরাট বড় বিপদে পড়েছে তাই ভিরু চোখে এদিক সেদিক সাহায্যের আশায় তাকাচ্ছে।


একটু আগে হালকা বৃষ্টি হয়েছিল। এখন বৃষ্টি নেই। আকাশে কাল মেঘ আর পূর্ণিমার চাঁদের লুকচুরি খেলা। স্টেশান থেকে একটু দূরেই বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ আর জলা ভুমি। চাঁদের আলো পড়ে কি অপরূপ সুন্দর লাগছে!



আর সব স্টেশানের মতই এই স্টেশানে অনেক কোলাহল। দুই তিনটা ট্রেন দাড়িয়ে আছে বিভিন্ন লাইনে। হকারদের কোলাহলে স্টেশান মুখরিত। স্টেশানের হলুদ আলো মুহিনের খুব ভাল লাগে। কেমন যেন একটা ঘোর অনুভব করে মুহিন। সে এদিক সেদিক চেয়ে একটা লোহার বেঞ্চির দিকে এগিয়ে যায়।


মুহিনের বয়স বেশি না। মাত্র ২৪ বছর।
সে পেশায় একজন নাবিক। সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজে চাকুরি করে। ছুটিতে সে দেশে এসেছে। সে ঠিক করেছে যে এইবার দেশে পুরো ৩ মাস ছুটি কাটাবে।


মুহিন একজন ছন্নছাড়া টাইপের ছেলে। কখন কি করে তার ঠিক নেই। আজ সকালেও সব ঠিক ছিল। বিকালের দিকে কি মনে হল তার কে জানে- হটাৎ মাকে বলল যে আজ রাতে বাসায় ফিরবে না। এক বন্ধুর বাসায় থাকবে।


তারপর বাসা থেকে সোজা স্টেশানে। সে নিজেও জানে না সে কথায় যাবে, কেন যাবে। তার আজ হটাৎ মনে হল একটু বেরিয়ে পড়া যাক। যে দিকে দুচোখ যায়। এমনি পাগল আমাদের মুহিন!


কেন সে মাঝে মাঝে এই পাগলামি করে এটা তার কাছে পরিস্কার না। হয়ত তার মনে কোন কষ্ট আছে কিংবা জমা আছে কোন ক্ষোভ যা কষ্টের চেয়েও বেশি পীড়া দেয় তাকে।
লোহার বেঞ্চিতে বসে পায়ের উপর পা দিয়ে বসল। জিন্সের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে আরেকটা সিগারেট ধরাল। তারপর উদাস দৃষ্টিতে তার চারপাশের মানুষগুলকে দেখতে লাগলো।


একটা আন্তঃনগর ট্রেন একটা লাইনের উপর থেমে আছে। একটু পরে মনে হয় ছেড়ে দিবে। যাত্রীরা আস্তে আস্তে ট্রেনে উঠছে। কেউবা দাড়িয়ে আছে দরজার পাশে। কেউ ট্রেন থেকে নেমে এই সুযোগে একটা সিগারেট খেয়ে নিচ্ছে। হকাররা ট্রেনের জানালার কাছে গিয়ে হাঁকাহাঁকি করছে- “এই কেক খান, পানি খান”!


আজকে মনে হয় মানুষ কম ট্রেনে। অবশ্য কম হবারই কথা। সপ্তাহের মাঝের একটা দিন আজ। বৃহস্পতিবার, শুক্রবার আর শনিবারে যাত্রী বেশি থাকে- সপ্তাহের অন্য দিনগুলো মানুষের ভীড় একটু কম থাকে। আজ তেমনি একটা দিন।


মুহিনের বিভিন্ন মানুষের জীবন যাত্রা দেখতে ভাল লাগে খুব। এই যে একটা ফকির তার পাশের বেঞ্ছিতে বসে এক মনে বিড়ি খেয়ে যাচ্ছে-এটা দেখতেও তার ভাল লাগছে, ঐযে একটা কিশোর ছেলে পানির গ্যালন হাতে নিয়ে পানি বিক্রি করছে এটাও ভাল লাগছে তার। মানুষের জীবন কি অদ্ভুত। সে তথাকথিত ভদ্র সমাজে থেকে ক্লান্ত হয়ে গেছে।


মুহিনের ইচ্ছে করে এই মানুষগুলোর সাথে যদি কিছুদিন কাটানো যেত! ইশ!! মুহিন মুগ্ধ চোখ তাকিয়ে দেখছে এই জীবন গুলোর জীবন প্রণালি।


হটাৎ একটা মিষ্টি সুরে চিন্তার ঘোর কাটে মুহিনের।
-ভাইয়া, একটু শুনেন।

মুহিন তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে!
হুম। শুধু মেয়ে বললে ভুল হবে মুহিনের। বলতে হবে এভাবে যে- একটা মেয়ে যার মুখে অসম্ভব রকমের মায়া আছে। ভীত হরিণীর মত কাজল দিয়ে ভরা দুটি চোখ। ভাবুক মুহিন অপলক চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। মেয়েদের দিকে এভাবে তাকানোটা মুহিনের স্বভাব বিরুদ্ধ তবুও এই অদ্ভুত পরিবেশে মেয়েটিকে যেন তার খুব মনে ধরেছে।



মেয়েটি আবার বলল-ভাইয়া, একটু শুনেন না।
-ও হ্যাঁ, দুঃখিত। কি জানতে চান বলুন। মুহিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দিল।

মেয়েটি বলল-ভাইয়া, এখানে তো দুটা ট্রেন। আমার ট্রেন কোনটা বুঝতে পারছি না। আমি ট্রেন থেকে নেমে একটু হাটতে বের হয়েছিলাম।
মুহিন বলল- ও আচ্ছা। এটা তো কোন সমস্যা না। আপনার ট্রেনের নাম মনে আছে?

মেয়েটি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল- হুম। মেঘনা এক্সপ্রেস।
মুহিন হেসে বলল-আরে এত জোরে মাথা নাড়েন কেন? মাথা তো ছিঁড়ে পড়ে যাবে।

মেয়ে বলল- কি করব ভাইয়া। ভয় পেলে আমার এমন হয়।
মুহিন আবার হেসে বলল- আরে ভয় পাওয়ার কি আছে? ট্রেন তো মোটে এখানে দুটা। একটা না হলে শিউর অন্যটা। দাঁড়ান আমি দেখতেসি। আসেন আমার সাথে।

মুহিন উঠে দাঁড়াল। তারপর একটা ট্রেনের দিকে হাটা ধরল। মেয়েটিও তার পেছন পেছন আসছে। বেচারি মনে হয় একটু বেশি ভয় পেয়েছে। তাই মুহিনের পিছনে শরীর ঘেঁষে হাঁটছে।

মুহিনের কেন যেন মনে হল- মেয়েটি তার সার্টের একটা কোনা ধরে রেখেচে আলতো করে। মেয়েটি হয়ত ভাবছে যে মেয়েটি হারিয়ে যাবে। মুহিনের চেহারায় কি এমন কিছু আছে যে কারনে সবাই তাকে দেখা মাত্রই বিশ্বাস করে। যেমন এই মেয়েটি করেছে। এই জিনিসটা মুহিনের খুব খারাপ লাগে। মানুষ তাকে এত বিশ্বাস করে যে মুহিন চাইলেই কারও বিশ্বাস ভাংতে পারে না। মুহিনকে যারা বিশ্বাস করেছে কারও বিশ্বাস নষ্ট করেনি মুহিন তবুও সবাই কেন মুহিনের বিশ্বাস ভাঙ্গে?


মুহিন একটা ট্রেনের কাছে গিয়ে একটা ভদ্র লোককে জিজ্ঞাস করল-ভাই এটা কি মেঘনা এক্সপ্রেস?
লোকটি মাথা না ঘুরিয়ে বলল- হ, আপনে যাইবেন কই?

মুহিন লোকটির কথা জবাব না দিয়ে মেয়েটির দিকে ফিরে জিজ্ঞাস করল- কত নং বগি মনে আছে?
মেয়েটি অসহায় গলায় বলল- না তো। তবে মধ্য দিকের একটা বগি হবে।

মুহিনের মেজাজ খুব খারাপ হল। বলল- আজব টিকিট দেখেন নাই আপনি? কোন বগিতে উঠছেন সেটা না জেনে নামলেন কেন?
মেয়েটি ভিরু গলায় বলল- ধমক দিচ্ছেন আমাকে? আমি তো টিকিট করিনি। টিকিট করেছে আমার বান্ধবি। আমরা একসাথে বাড়ি যাচ্ছি তো। ও ট্রেনের সিটেই আছে।
মুহিন বলল- তাই বলে আপনি একটু টিকিট দেখবেন না? আচ্ছা চলেন খুঁজে দেখি আপনার বান্ধবিকে।



তারপর দুজন ট্রেনে উঠল। বাহ! বাহির থেকে মনে হচ্ছিল যে ট্রেনে বুঝি ভীড় কম। এখন দেখা যাচ্ছে যে ভিড় আছে খারাপ না।

মুহিন আর মেয়েটি সামনের দিকে একটা কামরায় উঠেছিল। তাই তারা ট্রেনের সামনে থেকে পিছনের দিকে চলল।
বাহ! মেয়েটা এইবার তার জামা ধরল না। সোজা মুহিনের হাত ধরল শক্ত করে। এই চিকন শরীরে এত শক্তি কোথা থেকে আসলো? বিপদে পড়লে বুঝি এমনি হয়!

কত দিন পরে কোন মেয়ে মুহিনের হাত ধরল? শেষ যে মেয়েটি অনেক ভালবাসা নিয়ে মুহিনের হাত ধরেছিল সে মেয়েটির কথা মনে হতেই একটা বিষণ্ণতা অনুভব করল মুহিন। সাথে একটু কষ্ট- একটু না। অনেক কষ্ট অনুভব করল মুহিন।

একটা বগিতে ঢুকেই মেয়েটি মুহিনের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে চীৎকার দিয়ে একটা মেয়ের দিকে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। মুহিন বুঝতে পারল এটা মেয়েটির বান্ধবি। বান্ধবিকে একটু বুদ্ধিমতি মনে হচ্ছে।

মুহিন সেই বান্ধবিকে বলল- আপনার বন্ধু তো আজ এখানে হারিয়ে গিয়েছিল। এত বোকা মেয়েকে ছাড়েন কেন একা একা?

বুদ্ধিমতি বান্ধবি বুঝে নিল যে মুহিনই ওর বান্ধবিকে ট্রেন খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে।
মেয়েটি হেসে বলল- হারিয়ে ভাল করেছে। তা না হলে আপনার সাথে ওর দেখা হত কই?

বাপরে! একেবারে রেডি উত্তর। মুহিন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। হারিয়ে যাওয়া মেয়েটিও বেশি অপ্রস্তুত হল। বান্ধবির পিঠে একটা কিল মেয়ে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি বলল- যাহ্‌! তুই সব সময় একটু বেশি বুঝিস।

বুদ্ধিমতি বান্ধবীটি বলল-আমি যা বুঝি ঠিকই বুঝি। হুম ভাইয়া। ও নিশ্চয়ই ওর নাম বলে নাই। যাই হোক ওর নাম বর্ষা আর আমি নিতু। আমরা একটা ভার্সিটিতে একসাথে পড়ি। আমাদের বাড়ি একজায়গায়। ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি। এই বার ঝটপট আপনার পরিচয় দেন- তা না হলে ট্রেন ছেড়ে দিবে একটু পর।

বাপরে। মেয়েত পুরা বুলেট। মুহিন নিজের পরিচয় দিয়ে বলল- আপনারা ভাল থাকেন। আমি যাই।

মুহিন বিদায় নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে এল। চলে যাচ্ছে এমন সময় পিছন থেকে নিতু মেয়েটি জানালা থেকে ডাক দিল- ভাইয়া একটু শুনেন।

মুহিন জানালার কাছে গেল। মেয়েটি বলল- ভাইয়া, আর তো কখনো দেখা হবে না। আপনি চাইলে আমাদের ফোন নং নিতে পারেন।

মুহিন তাকিয়ে দেখল-নিতুর পেছন থেকে বর্ষা মেয়েটা উঁকি দিচ্ছে। লজ্জা পেয়ে সামনে আসতে চাইছে না।
মুহিন বলল- দরকার কি? থাকুক না। বেঁচে থাকলে অবশ্যই আবার দেখা হবে।

নিতু নিরাশ হল। বলল- ঠিক আছে ভাইয়া। আপনি ভাল থাকবেন।
মুহিন বলল- আপনারাও ভাল থাকবেন।



ট্রেনটির হুইসেল বেজে উঠল কুউ করে। মুহিনের মনটা হটাৎ বিষণ্ণতায় ভরে গেল। মেয়ে দুটো চলে যাবে এখনি। আর হয়ত আর জীবনেও তাদের সাথে দেখা হবে না তার। তবুও মেয়েটির জন্য কি অদ্ভুত টান অনুভব করছে সে! কিন্তু প্রকাশ করছে না সে।


ট্রেনটি আস্তে আস্তে চলা শুরু করল। নিতুর সাথে বর্ষাও জানালার পাসে এসে দাঁড়াল। মেয়েটির চোখেও কেমন একটা ব্যাকুলতা দেখতে পেল মুহিন।



ট্রেনটা কিছুদূর চলে গেছে। বর্ষা ট্রেনের জানালা দিয়ে মাথা বের করে মুহিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ট্রেনটি আরও জোরে চলা শুরু করেছে। মুহিন দেখল মেয়েটি জানালা দিয়ে হাত বের করে দিয়ে হাত নাড়ছে। মুহিন ও প্রতিত্তুরে হাত নেড়ে দেখাল। মেয়েটির ট্রেন একসময় হারিয়ে গেল অন্ধকারে।
তবুও মুহিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই দিকে।

মুহিন বুকের মধ্যে চিনচিন একটা বেথা অনুভব করল মেয়েটির জন্য। মুহিন আবারও ভাবল কি সুন্দর আমাদের জীবন কি অদ্ভুত সুন্দর আমাদের জীবন! ছোট ছোট কত ভালবাসায় ঘেরা আমাদের এই জীবন!


আকাশে আবার মেঘ জমেছে। কাল মেঘে আকাশের চাঁদ ঢেকে গেছে। বাতাসের প্রকৃতি দেখে অভিজ্ঞ নাবিক মুহিন বুঝল আবার বৃষ্টি হবে একটু পরে।


মুহিন ঘুরে দাঁড়াল। একটা খোলা চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা নিল। আগুন গরম ধোঁয়া উঠা গরম চা। তৃপ্তি ভরা চুমুক দেবার আগেই শুরু হল ঝুপ বৃষ্টি। আর সাথে সাথে স্টেশানের মানুষ গুলো ছুটতে শুরু করল নিরাপদ আশ্রয়ে।


খুব সাধারন একটা দৃশ্য, তবুও মুহিনের খুব ভাল লাগলো। মুহিনের গালে বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ছে। মুহিন তৃপ্তি নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল। অসাধারন লাগলো চায়ের স্বাদ। তার মনে হল সে কল্পনার এক জগতে চলে এসেছে।


রাত ১১ টা।
কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি শেষ হয়েছে।

মুহিন দাড়িয়ে আছে। কি করবে এখনো ঠিক করে নাই সে। বাসায় ফিরতে পারে কিংবা লাইনে দাঁড়ানো একটা ট্রেনে টুপ করে উঠে যেতে পারে সে। কি করবে বুঝতে পারছে না। আজ নিজেকে মুক্ত স্বাধীন মনে হচ্ছে।
সিগারেট শেষ তার। তাই একটা দোকান থেকে এক প্যাকেট বেনসন কিনল সে।


আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে আবার চাঁদ উঠেছে। মুহিন একটা ট্রেন লাইনের পাশ দিয়ে হাটা ধরল। খুব সুন্দর বাতাস ভেজা বয়ে যাচ্ছে। বাতাসে তার লম্বা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। মুহিন চাঁদের মৃদু আলোয় পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কথায় যাচ্ছে সে নিজেও জানে না।

একটা ট্রেন স্তেশান থেকে ছেড়ে আসছে তার পিছন দিক থেকে। সে পেছন ফিরে তাকাল।

ছোট একটা ট্রেন, অন্ধকার হয়ে আছে, ট্রেনের গতি মন্থর। মুহিন বুঝল এটা একটা লোকাল ট্রেন।

ট্রেনটা তার পাশ দিয়ে যাবার সময় সে হটাৎ কি মনে করে ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরে উঠে পড়ল।

২টি মন্তব্য: