expr:class='"loading" + data:blog.mobileClass'>
চলছে । চলবে । অবিরাম...

কুরআনের বরকত

বিশাল এক জাহাজ। সমুদ্রের বুক চিরে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলছে। লোকসংখ্যা প্রচুর। বাহির-ভিতর সর্বত্রই বনী আদমের ভীড়। তীল ধারণের ঠাঁই নেই যেন। প্রতিটি যাত্রীর চেহারায় হাসি-খুশি ভাব। কারণ আর দু'তিন দিন পরই গন্তব্যে পৌঁছবে তারা। কিন্তু খানিক বাদে তাদের হাসি-খুশি ভাব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মলিন হয়ে গেল সবার মুখ। রং-তামাশা ছেড়ে সবাই বেরিয়ে এল বাইরে। প্রতিটি নিঃশ্বাসে জপতে লাগল আল্লাহর নাম। সাগরে ঝড় উঠেছে। প্রচণ্ড ঝড়। বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে জাহাজের গায়। শান্ত-সমুদ্র এখন চরম-বিুদ্ধ। সীমাহীন উত্তাল। ঢেউয়ের আঘাত ও বাতাসের তীব্রতায় জাহাজটি একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে হেলছে। ক্যাপ্টেন তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে জাহাজটিকে রার জন্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হলেন। ঝড়ের তাণ্ডবে পড়ে জাহাজটি আস্তে আস্তে ডুবে যেতে লাগল। যাত্রীদের চোখে মুখে এখন মৃত্যুর ভয়াল ছাপ স্পষ্ট। প্রতিটি ক থেকে ভেসে আসছে করুণ আর্তনাদ। ওদের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে। সবাই বাঁচার জন্য উদগ্রীব। যাত্রীরা জানে, এ অবস্থায় ওদের বাঁচার কোনো আশা নেই। তবু ওরা বাঁচার জন্য চেষ্টা করছে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ছুটাছুটি করছে এখান থেকে সেখানে। কিন্তু বিম্ময়ের ব্যাপার হলো, এ বিপদ- সঙ্কুল পরিস্থিতিতেও এক নওজোয়ান সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন। তার চেহারায় কোনো মলিনতার ছাপ নেই। নেই ডুবে মরার কোনো ভয়-শঙ্কা। তার চেহারা আগে যেমন উজ্জ্বল ছিল, এখনও তাই আছে। তার অবস্থা অন্যান্য যাত্রীদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাহাজ ডুবে যাওয়ায় নওজোয়ান হাবুডুবু খাচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ সে একটি কাষ্ঠখণ্ড দেখতে পেল। বেশ বড়ই ছিল এটি। নওজোয়ান দেরী করল না। তাড়াতাড়ি তাতে চড়ে বসল। সে দেখল, যাত্রীদের কেউ আর বেঁচে নেই। ইতোমধ্যেই পানিতে ডুবে মারা গেছে সবাই। কাঠের টুকরাটি নওজোয়ানকে নিয়ে ভাসতে লাগল। ভাসতে ভাসতে একসময় উহা মালদ্বীপে গিয়ে ঠেকল। তীরে পৌঁছে নওজোয়ান আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করল। দু'রাকাত নামাজ
পড়ল। তারপর কান্ত পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে সে একটি জঙ্গলের কাছে পৌঁছল। সেই জঙ্গলে একটি কুঁড়েঘর ছিল। নওজোয়ান কুঁড়েঘরের কাছাকাছি গিয়ে বলল, ঘরে কে আছেন? দয়া করে একটু বেরিয়ে আসুন। নওজোয়ানের ডাকে এক বৃদ্ধ মহিলা বের হয়ে এলেন। বললেন, বাবা! তুমি কে? কোত্থেকে এসেছ? কেন এসেছ? কোথায়ই বা তোমার গন্তব্যস্থল? যুবক পূর্বের সব ঘটনা সবিস্তার
বর্ণনা করে বৃদ্ধাকে শুনাল। যুবকের কথা শুনে বৃদ্ধার মনে দয়ার সঞ্চার হলো। তিনি বললেন, বাবা! তোমাকে আমি আশ্রয় দিলাম। তুমি কোনো চিন্তা করো না। যতদিন মনে চায় আমার এই গরীবালয়ে অবস্থান করো। নওজোয়ান বৃদ্ধার নিকট থাকতে লাগল। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন
যুবক দেখল, বৃদ্ধা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। সে জিজ্ঞেস করল, মা! আপনি কাঁদছেন কেন? বৃদ্ধা বললেন, তোমার কাছে বলে কী আর হবে বাবা!
যুবক বললÑ বলেই দেখুন, আমি আপনার কোনো উপকার করতে পারি কি না? বৃদ্ধা বললেন, আমাদের দেশে বহু পূর্ব থেকে একটি নিয়ম চালু হয়ে আসছে। নিয়মটি হলো, প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে একজন যুবতী মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে গির্জায় নেওয়া হয়। সারারাত সে একাকি ঐ গির্জায় অবস্থান করে। দুঃখের বিষয় হলো, ঐ মেয়েটিকে সকাল বেলা আর জীবিত পাওয়া যায় না। মৃত অবস্থায় তার লাশ বের করা হয়। এ বছর ঐ দিনটি আগত প্রায়। আমি কাঁদছি এই জন্য যে, সরকারী লোকেরা গির্জায় দেওয়ার জন্য এ বৎসর আমার একমাত্র মেয়েকে নির্বাচন করেছে। বাদশাহ আমার নিকট এই ফরমান পঠিয়েছেন যে, আমি যেন আগামীকাল তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে সুসজ্জিত করে প্রস্তুত করে রাখি। বিকেলে নাকি বাদশাহের লোকেরা এসে তাকে নিয়ে যাবে। বৃদ্ধার মুখ থেকে এসব কথাবার্তা শুনে নওজোয়ান বলে উঠল, মা! আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ের পরিবর্তে আমাকে সাজিয়ে পরিপাটি করে বাদশাহর লোকদের হাতে অর্পণ করবেন। এরপর যা করার আমিই করব। বৃদ্ধা বললেন,
যদি বাদশাহ এ কথা জেনে যায়? নওজোয়ান বললেন, না কিছুতেই তিনি জানতে পারবেন না। হ্যাঁ, আপনার কাছে আবেদন হলো, আপনি কারো কাছে ঘুর্ণারেও এ কথা বলবেন না। নওজোয়ান ছিল খুব সুন্দর ও সুদর্শন। এখনো তার দাড়ি উঠে নি। মেয়েদের কাপড় চোপর পরিধান করিয়ে যখন তাকে সুন্দর করে সাজানো হলো, তখন বুঝার কোনো উপায় রইল না যে, সে কি পুরুষ না মহিলা? পরদিন বিকাল বেলা সত্যি সত্যি বাদশাহের লোকেরা বৃদ্ধার বাড়িতে এসে হাজির হলো। মেয়েটিকে প্রস্তুত করে রাখার জন্য বৃদ্ধাকে তারা অশেষ ধন্যবাদ জানাল। বলল, আজ পর্যন্ত যখনই কোনো মেয়েকে আনার জন্য গিয়েছি তখনই সেখানে সৃষ্টি হয়েছে এক বেদনাবিধুর পরিবেশ। কিন্তু আজই তার বিপরীত দৃশ্য দেখতে পেলাম। বাদশাহর নির্দেশের প্রতি আপনার অমলীন শ্রদ্ধা প্রদর্শন দেখে সত্যিই আমরা গর্ববোধ করছি। আসলে প্রতিটি নাগরিকের জন্য বাদশাহর নির্দেশ এভাবেই খুশি মনে,
বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেওয়া উচিত। যাহোক, বাদশাহের লোকেরা ঐ যুবককে যুবতী মনে করে গির্জায় নিয়ে গেল। গির্জাটা ছিল সমুদ্র তীরে। সেখানে যাওয়ার পর তারা ঐ যুবককে গির্জায় ঢুকিয়ে বাইরে দিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে এল। যুবক এখন একা। সেখানে আর কেউ নেই। আগেই সে অযু করে নিয়ে ছিল। বাদশাহর লোকজন চলে আসার পর সে দু'রাকাত নামাজ পড়ল। নামাজ শেষে কুরআনে পাক তেলাওয়াত করতে শুরু করল। সে ছিল কুরআনের হাফেজ। তাই মুখস্ত কুরআন পাঠে তার কোনোই অসুবিধা হলো না। রাত যখন গভীর হলো তখন সে দেখল, সমুদ্র থেকে একটি দানব ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে তার দিকে এগিয়ে আসছে। এ অবস্থা অবলোকন করে নওজোয়ান আরো উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করতে লাগল। এভাবে কিছুণ চলার পর ঐ দানবটি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। যুবক ঐ দানবটিকে দেখার জন্য সমুদ্রের সবদিকে দৃষ্টি ফেলল। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেল না। এতে সে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলল। সেই সাথে মনটাও আনন্দে ভরে গেল। পরদিন। নিয়মানুযায়ী বাদশাহর লোকেরা লাশ নিতে এল। কিন্তু দরজা খুলে লাশের পরিবর্তে জলজ্যান্ত একটি মানুষ দেখে তারা কেবল আশ্চর্যই হলো না, নির্বাকও হয়ে গেল। কিছুণ তাদের মুখ থেকে কোনো কথাই বের হলো না। খানিক পর তারা জিজ্ঞেস করল, ওহে! কোন জিনিস তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখল? সে তখন সব কিছু খুলে বলল। তারা বলল, ঠিক আছে। আজকেও তোমাকে সেই পরীর সম্মুখীন হতে হবে। যুবক বলল, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি আজও গির্জায় রাত কাটাতে রাজি আছি। কিন্তু আমার শর্ত আছে। শর্তটি হলো, আজও যদি আমাকে আমার মাওলা বাঁচিয়ে রাখেন, তাহলে তোমাদের সবাইকেই মুসলমান হতে হবে। তারা বলল, তোমার শর্ত মেনে নিলাম আমরা। আমরা ওয়াদা করছি যে, তুমি যদি আজও বেঁচে যাও, আমরা তাহলে সবাই মুসলমান হয়ে যাব।
শর্ত মেনে নেওয়ার পর রাতের বেলা যুবককে পূর্বের ন্যায় গির্জায় রাখা হলো। আল্লাহর অপরিসীম রহমতে কুরআন পাঠের বরকতে আজও সে বেঁচে গেল। পরদিন তাকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেলে স্বয়ং বাদশাহসহ অসংখ্য লোক ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিল। উল্লেখ্য যে, এই যুবকের নাম আব্দুর রহমান। [সূত্রঃ তিরমিযি শরীফের
ব্যাখ্যাগ্রন্থ শরহে মাদানিয়া]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন