expr:class='"loading" + data:blog.mobileClass'>
চলছে । চলবে । অবিরাম...

তেপ্পান্ন তাস


জীবন নামের কারাগার অনেকটা তেপান্ন তাসের কানা গলির মতো মাঝে মাঝে বিচিত্র হয়ে উঠে। আর এই তেপ্পান্ন তাসের একটা খেলা হচ্ছে পোকার। বিষণ্ণ মলিন এই মেয়েটা নিয়মিত পোকার খেলে। এটাই এখন তার জীবন। এটাই তার একাকীত্ব জীবনের সঙ্গী। অথচ তার এখন হাসিখুশি না থাকার কোন কারন ছিলও না। কি নেই তার? কিসের অভাব? হুম সব কিছুর মাঝেও তার একটু খানি সঙ্গের বড্ড অভাব। আর যখন পোকার টেবিলে ভীষণ চঞ্চল এই মেয়েটার প্রচণ্ড ঝগড়া হচ্ছে সুইডিশ একটা ছেলের সাথে তখন অন্যেরা বেশ মজা নিয়েই সেটা উপভোগ করছে। মেয়েটা শেষ পর্যন্ত হারেনি। কিভাবে কিভাবে যেন ছেলেটার সব চিপস নিয়ে ফেলল। ইমেলেন নামের ছেলেটা কিন্তু ভীষণ ধীর স্থির তার হারার কথা ছিলও না। তবুও কেন যেন হেরে গেলো সে। শেষমেশ সে বাডি অফার করলো মেয়েটাকে যাতে পরবর্তীতে হারাতে পারে। ভীতুর ডিম এই বাঙালি মেয়েটাকে হারানোর জন্য এখন ইমেলেন সব সময় পোকার টেবিলে বসে থাকে আর নাইমা নামের এই মেয়েটা তো আগে থেকেই পোকার পাগল। তাই ওদের নিয়মিত কথা হতে থাকল পোকার টেবিলে। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে ওরা বন্ধু হোল ফেবুতে। দিন গড়িয়ে যায় আর ওদের কথার পরিমান তার চেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকে। আর কথার কোন শুরু শেষ নেই। কি নিয়ে যে কথা হয়না সেটাই ওরা জানে না। 

ইমেলেনের এখন আর পোকার খেলতে ভালো লাগে না। তার এখন নাইমার সাথে কথা বলতেই ভালো লাগে। ওরা শেয়ার করে ওদের ছবি একজন আরেকজনের সাথে। ইমেলেন চমকে উঠে, বাদামি চেহারার একটা মলিন মুখ দেখে। ওর মনে হয় অনেক অনেক বিষণ্ণ এই মেয়ে। ওর অনেক খারাপ লাগে। খুব ইচ্ছে হয় একটু ছুয়ে দিতে মেয়েটাকে। কিন্তু টা কি আর হয়? মাঝখানে যে যোজন যোজন দূরত্ব। কিন্তু ইমেলেন বুঝতে পারে ভীষণ রক্ষণশীল এই মেয়েটাকে তেমন কিছু বলতে যাওয়া মানে মেয়েটাকে হারানো। তাই সে সেই সাহস পায়না। ইমেলেনের খাওয়া ঘুম সব উলটপালট হয়ে যায়। সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ ইমেলেন এখন আর সফটওয়্যারে শান্তি পায়না। তার এখন ফিলসফি ভালো লাগে।

নাইমা সে খুব ভালো একজন বন্ধু পেয়ে বেশ খুশি। ইমেলেন নামের এই বিদেশি ছেলেটাকে তার বেশ ভালো লাগে। কতো কিছুই না জানে সে। যখন আকাশে অনেক মেঘ করে, যখন অনেক অনেক বৃষ্টি হয়, যখন এক ফালি চাঁদ মেঘের নিচ থেকে বের হয়ে আসে তখন আগের মতো আর উদাস হয়ে যায়না মেয়েটি। সে বেশ উপভোগ করে এই সব। ভালো লাগে তার নিচের দোকান থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চটপটি খেতে। তার চঞ্চলতা কমতে থাকে। সেখানে ধীরে ধীরে ফুটে উঠে নতুন সূর্যের দীপ্তি। সেই সূর্যের আলোয় আসে পাশের মানুষগুলো চমকে উঠে। কামনাসক্ত অনেক চোখ যারা এতো দিন খেয়ালি করেনি তারা চকচক করে উঠে। কিন্তু পরিপার্শ্ব থেকে হাজার মাইল দূরে যে এতো দিন বড় হয়েছে তার তো এতো কিছু বোঝার প্রস্নই আসে না।

ধিরস্থির ইমেলেন আর চঞ্চল নাইমা যেন বদলে যায়, সরে আসে নিজের কক্ষপথ থেকে অন্যের কক্ষপথে। এরি মাঝে বেশ সুন্দর একটা ছেলে প্রপোজ করে বসে নাইমাকে। জীবনের প্রথম প্রপোজ পেয়ে নাইমা বেশ অবাক হয়। তার চেয়ে বেশী পায় ভয়। উত্তেজিত নাইমা তখনই ফিরে আসে বাসায়। শেয়ার করে সব কিছু তার প্রিয় বন্ধুটির সাথে। ইমেলেন জিজ্ঞেস করে," আচ্ছা ভয় পাবার কিছুই নেই। এমনটা হতেই পারে। কিন্তু তুমি কি ছেলেটাকে ভালোলেগেছে?" ভীষণ লজ্জায় নাইমা উত্তর দেয়,"হুম"

ইমেলেনের সমগ্র পৃথিবী যেন পেন্ডুলামের মতো দুলে উঠে। দুলে উঠে প্রচণ্ড সমুদ্রে ঝড়ের মাঝে পরে যাওয়া কোন জাহাজের মতো। সে বলে," বেশ তো" তাহলে একটু দেখো যদি ভালো মনে হয় তবে রাজী হয়ে যেও" প্রিয় বন্ধুর কথায় ভরসা পায় নাইমা। সে কয়েকদিন পর ছেলেটাকে হ্যাঁ বলে দেয়।

জীবনের প্রথম ভালবাসার মানুষটিকে নিয়ে নাইমা খুব উত্তেজিত। সারাক্ষণ সে ফোন দেয় আদিবকে। আদিব কথা বলে অনেক। অনেক অনেক রসিক। নাইমা বেশ খুশী আদিবকে নিয়ে। ওরা মাঝেই মাঝেই ঘুরতে যায় রিক্সায় কিংবা আড্ডা দেয় কোন এক কফি হাউজে। এসবই সে প্রতিদিন বলতে থেকে ইমেলেনের সাথে।

পাগল প্রায় ইমেলেন সবই শুনতে থাকে। আর অনেক অনেক অনেক কষ্ট নিয়ে যেন জীবন্মৃতভাবে বেচে থাকে। তার ইচ্ছে হয় মরে যেতে। ইমেলেনের এমনিতেই হাতেগোনা অল্প কিছু বন্ধু। তারা কিন্তু বেশ বুঝতে পারে সবকিছুই। তারা অনেক বুঝাতে থাকে ইমেলেনকে। কিন্তু তাতে কি আর ভালবাসা কমে? ভালবাসা যে অপরিবর্তনীয় একটা বিষয়।

আদিব বেশ বুঝতে পারে এই মেয়েটা অনেক অনেক রক্ষণশীল। যেন একটা সদ্য ফোঁটা কুঁড়ি। তার খুব ইচ্ছে হয় ছিরে ফেলতে কিন্তু কোথায় যেন আটকে যায় সে। বারবার বারংবার। একাধিক মেয়ের সাথে সম্পর্ক থাকা আদিব সব ছেড়ে দিয়ে নাইমার মাঝে বিলীন হয়ে যেতে চায়। সেও বুঝতে পারে সে ভালবেসে ফেলেছে নাইমাকে। তাই সে নাইমাকে স্পর্শ করতে পারে না। যখন আদিব তার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে সবাই বেশ একচোট হেসে ফেলে। আদিব তুই তো এমন কথা অনেকবারি বলেছিস। আদিব বলে দেয় না দোস্ত এটাই শেষ। আমি আর অন্য কোন মেয়ের সাথে রিলেশন রাখবো না। সবগুলো ছেড়ে দিবো।

এদিকে নাইমার ফোন নাম্বার নিয়েছে ইমেলেন। মাঝে মাঝে ফোন দেয় সে। সুইডিশ উচ্চারনে ইংরেজি আর বাংলিশ ইংরেজি দুটো মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তবে বন্ধুত্তের খাতিরেই হোক কিংবা অন্য কারনে ওদের কোন সমস্যা হয় না। ইমেলেনের কয়েকজন বন্ধু ফেবুতে ফ্রেন্ড রিক পাঠায় নাইমাকে। কিন্তু কথা বলার সুযোগ হয়না তাদের। কারন নাইমা এখন অনেক ব্যস্ত আদিবকে নিয়ে।

এরি মাঝে একদিন নাইমা বই কিনতে চলে আসে নীলক্ষেত। সাথে একমাত্র বান্ধবী অ্যানা। তখনি নাইমার দেখতে পায় আদিব আর একটা মেয়ে খুব ঝগড়া করছে এক কফিশপে বসে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় নাইমা। শুনতে পায় মেয়েটা বলছে," যদি রিলেশন ব্রেক করতেই চাও তাহলে আমার সাথে রিলেশন করে ছিলে কেন? তুমি একটা ফ্রড", বিধ্বস্ত নাইমার জন্য এর বেশী কিছু দরকার ছিলো না। প্রচণ্ড শক পায় নাইমা। দ্রুত ফিরে আসে বাসায়। অনেক বুঝায় অ্যান। কিন্তু আজ যে আকাশে কালবৈশাখী। ডুকরে ডুকরে কান্না করতে থাকে নাইমা। সারাদিন নিজের রুম থেকে বের হয় না সে। যখন নাইমা চলে আসছিলো তখন ওকে দেখতে পায় আদিব। একেরপর এক মেসেজ করতে থাকে। একটাও খুলে দেখার ইচ্ছে হয়না নাইমার। শেষ পর্যন্ত সবকিছু শেয়ার করার মতো একটা মুখই মনে পড়লো ওর। ও ফেবুতে আসে ইমেলেনের সাথে কথা বলার জন্য। সেখানে এসেই এক গাঁদা মেসেজ পায় নাইমা। সবগুলো ইমেলেনের বন্ধুদের কাছ থেকে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে ইমেলেনের এক বছর আগের এবং বর্তমান ছবি। এবং ইমেলেনের সর্বশেষ এক বছরের ডায়েরীর ফটোকপির সফট কপি। সারারাত ধরে সেগুলো পড়তে থাকে নাইমা। সকালে সে ফোন দেয় ইমেলেনকে। 

তোমাকে একবার ছুয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ইমেলেন আদিবের কথা জিজ্ঞেস করে। নাইমা জানায় সব কিছু। তারপর আবার বলে তোমাকে খুব ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। হাঁসপাতালের বেডে অসুস্থ ইমেলেনের জন্য আর কিছুর দরকার নেই। সে তখনি ঢাকার পথে রওনা দেয়ার চেষ্টা করে। বন্ধুদের সব বাধা উপেক্ষা করে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় চলে আসে। নাইমাকে যখন ফোনে বলে,"Naima i'm on Dhaka", নাইমা তখনি রওনা দেয় একটা ট্যাক্সি নিয়ে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে। আর আদিব নাওয়া খাওয়া ছেড়ে সারাক্ষণ নাইমাদের বাসার সামনেই বসে থাকতো কখন নাইমা বের হবে,  কখন নিজের সব ভুল স্বীকার করবে, সেই আশায়। উদ্ভ্রান্ত নাইমাকে ট্যাক্সি নিতে দেখে সেও বাইক নিয়ে পিছু নেয় নাইমার। এবার যে নাইমাকে বুঝাতেই হবে। কিন্তু হায় ভাগ্যের পরিহাস বড্ড তেপ্পান্ন তাসের মতো। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। 

এরপর নাইমা যখন বিমানবন্দরে পৌঁছে প্রথম ইমেলেনকে দেখতে পায়, পায়ে পায়ে ফিরে যায় ইমেলেনের কাছে। তারপর পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে গত একবছরে অর্ধেক হয়ে যাওয়া ইমেলেনকে। আর তখন সমুদ্র যেন সান্ত হয়ে যায়। সব ঝড় যেন থেমে যায়।

আদিব যখন ওদের দেখতে পায় তখন আদিব শুধু বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেই দৃষ্টি একটা অবুঝ শিশুর অসহায় দৃষ্টি।

(সংগ্রহেঃ শিশিরের বিন্দু)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন